
বরিশাল দধি ঘর প্রায় শত বছরের ঐতিহ্য : এখনো স্বাদে অনন্য

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বরিশাল পোস্ট : বরিশালের প্রাণকেন্দ্র গির্জা মহল্লার ব্যস্ততম সড়কে, ঝলমলে শপিং মল আর আধুনিক খাবারের দোকানের ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট, জরাজীর্ণ টিনের ঘর। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, ভিতরে কতটা ইতিহাস আর স্বাদের গল্প জমে আছে। কিন্তু যিনি একবারও এসেছেন, তিনি জানেন — এটাই সেই ‘বরিশাল দধি ঘর’, যা ৯৫ বছর ধরে খাঁটি দুধের দই, ঘোল, মাখন, চিড়া ও মুড়ির স্বাদে মুগ্ধ করছে দেশজুড়ে লাখো ভোজনরসিককে।
৯ দশকের ঐতিহ্য, একটাই স্বাদ
১৯৩০ সালে বাবুগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাশা গ্রামের মিনহাজ উদ্দীন রাজ যখন এই দোকান শুরু করেন, তখন হয়তো ভাবেননি তার হাতে গড়া ছোট দোকান একদিন হয়ে উঠবে বরিশালের প্রতীক। প্রথমে একজন কারিগর হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরে নিজেই শহরের কেন্দ্রস্থলে গড়ে তোলেন এই দধি ঘর। আজ সেই ছোট্ট দোকানটির হাল ধরেছেন চতুর্থ প্রজন্মের মাহমুদুল হাসান।
দোকানটির সবচেয়ে বড় পরিচয় – ‘স্বাদে কখনো বদল আসেনি।’ ঢাকার বাসিন্দা ইকবাল বিন হাবিব বলেন, “৩৫ বছর আগে যেমন খেয়েছিলাম, আজও সেই একই স্বাদ।” এ যেন এক ‘টাইম ক্যাপসুল’ যেখানে সময় থেমে আছে দইয়ের বাটিতে।
স্বাদে খাঁটি, পরিবেশে সাদামাটা
বর্তমানের আধুনিক রেস্তোরাঁ মানেই বাহারি ডেকোরেশন, ইনস্টাগ্রামময় পরিবেশ আর ব্র্যান্ডিং। তবে ‘বরিশাল দধি ঘর’ এসব কিছুতেই নেই। তাদের ডেকোরেশন বলতে আছে পুরনো কাঠের বাক্সের রেডিও, দেয়ালে লাগানো সেই যুগের একটি ঘড়ি — যা আজও সময় ঠিকই জানিয়ে দেয়। খাবার পরিবেশন করা হয় সাদামাটা কাসার বাটিতে।
এখানে একেকটি বাটিতে থাকে দই, মিষ্টি মুড়ি, ঘোল, চিড়া কিংবা মাখন — দাম মাত্র ৩০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে। অথচ সেই স্বাদই আবারো টেনে আনে খদ্দেরকে।
প্রতিদিনের প্রস্তুতিতে খাঁটি দুধের কারিশমা
দধি ঘরের মূল আকর্ষণ দই, যার জন্য প্রতিদিন ছয় থেকে সাত মণ খাঁটি দুধ ব্যবহার করা হয়। ৫০ বছর ধরে দধি প্রস্তুতের দায়িত্বে থাকা ৬৭ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন,
“প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে শুরু হয় দুধ জ্বাল দেওয়ার কাজ, চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। এরপর তা ছেঁকে দই বীজ দিয়ে ডেগে তোলা হয়। পাটের বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় নিভন্ত চুলার ওপরে। সকালে তৈরি হয় জমাট বাঁধা দই।”
এই প্রক্রিয়া, এই যত্ন আর নিষ্ঠাই হয়তো আজকের দধি ঘরের প্রাণ।
ভোজনরসিকদের মিলনমেলা
বরিশাল দধি ঘরে শুধু বরিশালের মানুষই নয়, আসেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ। অনেকেই বরিশালে এলে প্রথমেই যান এই দোকানে। শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার বলেন,
“বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই আসি এখানে। অন্য কোথাও এমন খাঁটি স্বাদ পাই না।”
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি, দই-মুড়ি, চিড়া আর মাখনের স্বাদ নিতে ভিড় লেগেই থাকে। দোকানের মালিক-কর্মচারীদের যেন এক মুহূর্তও দম ফেলার সময় নেই।
চার প্রজন্মের নিরবিচার উত্তরাধিকার
মিনহাজ উদ্দীনের পর তার বড় ছেলে আদু রাজ, পরে ছোট ছেলে আজিজ রাজ এবং বর্তমানে মাহমুদুল হাসান — এই দীর্ঘ যাত্রায় লাভ সবসময় আগের মতো না হলেও স্বাদে ও মানে কোনো আপস হয়নি। বর্তমান পরিচালক মাহমুদুল হাসান বলেন,
“মানুষের ভালোবাসা, আস্থা আর স্বাদকে গুরুত্ব দিয়েই আমরা দোকান চালিয়ে যাচ্ছি। এটা কেবল ব্যবসা নয়, একটা দায়িত্ব।”
বরিশালের আত্মার অংশ
‘বরিশাল দধি ঘর’ শুধুমাত্র একটি খাবারের দোকান নয়। এটি বরিশালের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। নব্বই বছরের বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এই প্রতিষ্ঠানটি প্রমাণ করে, শুধুমাত্র খাঁটি স্বাদ আর নিষ্ঠা দিয়েই কাস্টমারের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া যায়।
একটি জরাজীর্ণ দোকান আজ হয়ে উঠেছে ‘স্বাদের প্রতীক’, ‘আস্থার ঠিকানা’ আর ‘বরিশালের আত্মার অংশ’।