
বরিশাল কারাগারে সাবেক মেয়রের বিলাসী জীবনযাপন!
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বরিশাল পোস্ট ॥ কারাগার সাধারণ বন্ধীদের জন্য কষ্টের জায়গা হলেও বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার এক আওয়ামী লীগ নেতার জন্য আয়েশী জীবনের স্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে। তিনি হলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বিনাভোটে তিনবারের গৌরনদী পৌরসভার সাবেক মেয়র হারিছুর রহমান হারিছ।
গোটা জেলাজুড়ে দানব হারিছ বলেখ্যাত হারিছুর রহমানের কারাগারের আয়েশী জীবন নিয়ে গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা জাকির হোসেন সান্টু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার এমন স্ট্যাটাসের পর বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে জাকির হোসেন সান্টু লিখেছেন- গৌরনদী উপজেলার সকল রাজনৈতিক সংগঠনের ঘৃণিত চামার হারিছকে কোর্টের গারদে বসার জন্য একটি হাতা ছাড়া চেয়ার দেওয়া হয়েছে। ফোনে দীর্ঘক্ষন কথা বলাসহ প্রতিদিন বাহিরের ভালো ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। আজকেও তাকে সকালের নাস্তা বাহির থেকে এনে গারতেই দেওয় হয়। মামলা তারিখে তাকে আদালতের বিচারকের সামনে হাজির করা না হলেও শুধু আরাম আয়েশের জন্য তাকে জেল থেকে কোর্টে আনা হয়।
স্টাটাসে তিনি আরো লিখেছেন-জেলে তাকে (হারিছ) টাকার বিনিময়ে আলাদা ভাবে রাখা হয়। যেখানে অন্যান্য আসামিরা জেলে চরম কষ্টে থাকে, সেখানে তাকে (হারিছ) রাজকীয় অভ্যর্থনা করার সাধারণ হাজতীরা মনে করেছেন হারিছ এখনো অনেক ক্ষমতার মালিক। তার অনুসারী সকল লোকজন দলবেঁধে তার সাথে কোর্টের গারদে সাক্ষাতের সুযোগে অন্য হাজতীরা চরম ক্ষুব্ধ। ছবিটি তুলতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই।
স্ট্যাটাস দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বুধবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন সান্টু বলেন, কয়েকদিন আগে একটি মামলার হাজিরা দিতে কোর্টে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি কোর্ট হাজতে চেয়ারে বসে মোবাইলে কথপকথন করছে হারিছ। এছাড়াও জামিনে বের হওয়া ব্যক্তিরারও জানিয়েছেন, কারাগারে বেশ আরাম আয়েশে আছেন হারিছ। এনিয়ে মূলত ফেসবুক স্ট্যাটাসটি দিয়েছি।
অতিসম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে বের হওয়া একাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ সাধারণ বন্ধীরা জানিয়েছেন, জাকির হোসেন সান্টুর ফেসবুক স্ট্যাটাস একটুও মিথ্যে নয়। কারাগারে অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারা কষ্টে থাকলেও সন্ত্রাসী হারিছের বেলায় ভিন্ন। সে কারাগারে বেশ আরাম আয়েশে রয়েছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা মেয়াদে নিজ দলের প্রকৃত নেতাকর্মী থেকে শুরু করে গৌরনদী উপজেলা বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর অসংখ্য হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার প্রধান ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের সাবেক পৌর মেয়র হারিছুর রহমান। সেসময়ে হামলার শিকার অনেক নেতাকর্মীরা এলাকায় থাকতে না পেরে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। যেকারনে তারা মামলা পর্যন্ত করতে পারেননি।
সূত্রে আরও জানা গেছে, শুধু গৌরনদী উপজেলাতেই নয়। গোটা বরিশালজুড়ে রামরাজত্ব কায়েম করেন হারিছুর রহমান। এজন্য বিভিন্ন সময় বরিশালের দানব হারিছ বলে প্রকাশ্যে গণমাধ্যমের সামনে বক্তব্য দিয়েছেন তার (হারিছ) আপন ভাইয়েরা। সূত্রমতে, বিগত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর হামলার শিকার হওয়া ক্ষতিগ্রস্থ অনেক নেতাকর্মীরা হারিছুর রহমানের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন। বিএনপি নেতাদের দায়ের করা মামলায় গত বছরের ২৯ অক্টোবর সকালে ঢাকার রামপুরা থানা পুলিশের সহযোগিতায় গৌরনদী মডেল থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে বনশ্রী এলাকায় আত্মগোপনে থাকা হারিছুর রহমানকে গ্রেপ্তার করেন। তাকে (হারিছ) গ্রেপ্তারের পর গৌরনদী থানায় নিয়ে আসার খবর ছড়িয়ে পরলে হারিছ ও তার বাহিনীর হাতে হামলা ও মামলার শিকার হাজার হাজার নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষ গৌরনদী বাসষ্ট্যান্ডে জড়ো হয়ে হারিছের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে না পারার কারণে গৌরনদী থানায় হারিছকে আনা হয়নি। ওইদিন সন্ধ্যায় যৌথ বাহিনীর সহায়তায় থানা পুলিশ সড়ক পথে হারিছকে আদালতে সোর্পদ করার পর বিচারক তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। সেই থেকে হারিছুর রহমান হারিছ বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, হারিছুর রহমান কারাগারে থাকলেও বাহিরে থাকা তার নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের সংগঠিত করে রাখতে গত ঈদ-উল ফিতরের পূর্বে হারিছুর রহমানের স্ত্রী ও তার দুইজন ক্যাডারের মাধ্যমে বাহিনীর সদস্যদের বিকাশ নাম্বারে পাঁচ হাজার করে টাকা পাঠানো হয়েছে।
সূত্রটি আরও জানিয়েছেন, বিনাভোটে একটানা তিনবার গৌরনদী পৌরসভার মেয়র থাকাকালীন সময় হারিছুর রহমান পুরো এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলেন। ওইসময় তিনি (হারিছ) ছিলেন গৌরনদী উপজেলার একক নিয়ন্ত্রন কর্তা। ফলে এলাকায় কোনধরনের উন্নয়ন না করেই পৌরসভাসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছেন। এলাকাবাসী হারিছুর রহমানের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে সঠিক তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদক কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি করেছেন।
এ ব্যাপারে গৌরনদী উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব শরীফ জহির সাজ্জাদ হান্নান বলেন, জালিম ও ফ্যাসিষ্ট সরকারের কোন লোক যাতে কারাগার তথা অন্যকোথায়ও সুযোগ-সুবিধা না পায় সেজন্য খুব শীঘ্রই আমরা অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করে স্মারকলিপি পেশ করবো।
বুধবার দুপুরে বরিশাল আদালতের গৌরনদীর কোর্ট জিআরও বেলাল হোসেন বলেন, আমার ডিউটিকালীন সময়ে হারিছুর রহমানকে তিনবার এজলাসে আনা হয়েছিলো। সরকারি নিয়মের বাহিরে আমি তাকে কোন সুবিধা দেইনি। এরপর আর তাকে আমার এজলাসে আনা হয়নি। হাজতখানায় সে কি সুযোগ নেয় তা আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন ভূঞার কাছে জানতে চাইলে তিনি চরম বিরক্তী প্রকাশ করে বিষয়টি উদ্ভট কথাবার্তা বলে দাবি করে জেল সুপারের সাথে কথা বলার জন্য বলেন। এ বিষয়ে জানতে সিনিয়র জেল সুপার মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেনের ব্যবহৃত (০১৭৬৯-৯৭০৮১০) মোবাইল নাম্বারে যোগােযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় কোন বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।